মহারাজার মৃত্যুদণ্ডঃ প্রথম চার্লস এর গল্প

তোমরা জানো যে আমাদের দেশ গণতান্ত্রিক দেশ, আমাদের দেশে আর কোনো রাজা নেই। কিন্তু এক সময় ছিল। সারা পৃথিবী জুড়েই রাজা ছিল, রানী ছিল, রাজত্ব ছিল। রাজারা কর নিত, দেশ শাসন করতো, আবার দোষী ও নির্দোষীদের সাজাও দিত। সাজা ছিল হরেক রকম। সব সাজার বড় সাজা ছিল মৃত্যুদণ্ড, কোথাও বা শূলে চাপিয়ে নেওয়া হত প্রাণ কোথাওবা শিরশ্ছেদ করে। প্রাণ যেভাবেই নেওয়া হোক, দোষী সর্বদা প্রজাই হত। রাজারা কখনো দণ্ড পেত না, রাজারা মরত যুদ্ধে অথবা গুপ্ত ঘাতক বা বিশ্বাস ঘাতকদের হাতে। এ কেমন কথা হল? রাজা কি তাহলে দোষ করেনা? করে, এবং সবার চেয়ে বেশিই করে, তবুও তার সাজা হয়না, রাজার আবার কিসের সাজা! তবে একবার হয়েছিল, রাজার বিচার হল তারপর মৃত্যু দণ্ডও হল। চল আজ তোমাদের সেই গল্পই বলি।

১৬২৫ খ্রিস্টাব্দে রাজা জেমস স্টুয়ার্‌ট এর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র প্রথম চার্লস সিংহাসনে বসেন। চার্লসের সবসময়ই টাকার প্রয়োজন থাকতো, এই প্রয়োজন আরও বেড়ে যায় স্পেন ও ফ্রান্স উভয় দেশের সঙ্গে তার যুদ্ধ শুরুর পর । বেশ কয়েকবার পার্লামেন্ট তাকে টাকা দিতে অমান্য করার পর তিনি পার্লামেন্ট ভঙ্গ করে দেন।

প্রথম চার্লস


কিন্তু ১৬২৮ খ্রিস্টাব্দে তাকে আবার পার্লামেন্ট ডাকতে হয়, এইবার পার্লামেন্ট তাকে জানায় যে Petition of Rights নামে একটি দলিলে স্বাক্ষর করার পূর্বে পার্লামেন্ট কোন টাকা দেবে না। ফলে বাধ্য হয়ে রাজাকে এই আর্জি পত্র অনুসারে নিম্নলিখিত চারটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে হয়,

) কোন ব্যক্তিকে উপযুক্ত কারণ ছাড়া তিনি কয়েদ করবেন না।

) পার্লামেন্টের অনুমতি ছাড়া কোনরূপ কর চাপাবেন না।

) কারো ব্যক্তিগত বাড়িতে সৈন্য রাখা যাবেনা।

) শান্তিকালীন সময়ে মার্শাল আইন আরোপ করা যাবেনা।

আর্জি পত্রে স্বাক্ষর করা পর্যন্তই শেষ, এর একটি নিয়মও তিনি মেনে চলেননি। কিন্তু এই পিটিশনটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ, এই পিটিশনে রাজার উপরে স্থান পেয়েছিল আইন। যাহোক, ১৬২৯ সালে তিনি আবারও পার্লামেন্ট ভঙ্গ করেন, এবং পুনরায় সভা বসাতে গররাজি হন। টাকা আদায়ের জন্য ইংরেজ নাগরিকদের উপর সমস্ত রকমের কর ও জরিমানা আরোপ করেন। এর ফলস্বরূপ তার জনপ্রিয়তা দিনে দিনে হ্রাস পায়।

প্রথম চার্লস এর আরও এক ইচ্ছা ছিল যে তার রাজত্বে কেবল একটি ধর্ম বিশ্বাস থাকবে। তোমরা হয়ত জাননা যে খ্রিস্ট ধর্মের মধ্যেও আলাদা আলাদা বিশ্বাস আছে, এখানে ক্লিক করে তোমরা সে বিষয়ে জেনে নিতে পারো। চার্লস প্রথমেই Anglican পন্থার রীতিনীতি সমর্থন করে পিউরিটানদের অসন্তুষ্ট করেন। তারপর তাঁর বিশ্রী স্বপ্ন পূরণ করতে, ১৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে প্রেসবিটেরিয়ান স্কটল্যান্ড বাসিকে এংলিকান প্রেয়ার বুক এর একটি সংস্করণ গ্রহণ করিয়ে নিতে চেষ্টা শুরু করেন। এর ফলস্বরূপ স্কটল্যান্ড বাসীরা মহারাজার বিরুদ্ধে শুরু করল বিদ্রোহ, তৈরি করল এক বিশাল সেনা বাহিনী, এমনকি ইংল্যান্ড প্রবেশেরও হুমকি দিল। চার্লস পড়লেন মহা বিপদে। এই বিপদের হাত থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজন অনেক টাকার, টাকার ব্যবস্থা হতে পারে একমাত্র পার্লামেন্টের মাধ্যমেই। তাই বাধ্য হয়ে আবারো পার্লামেন্ট ডাকলেন রাজা। অনেক বছর পর পার্লামেন্ট আবার সুযোগ পেল রাজার বিরোধিতা করার।

১৬৪১ সালে রাজার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে বেশ কিছু আইন পাশ করল। ক্রোধান্বিত চার্লস ১৬৪২ সালে পার্লামেন্টের ৫জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করানোর প্রচেষ্টা করেন, কিন্তু কোন ভাবে ওরা পালিয়ে যায়। সমভাবেই ক্রোধান্বিত লন্ডনবাসী জনতা রাজপ্রাসাদের বাইরে জড়ো হয়। লন্ডন ছেড়ে পালান চার্লস, যান ইংল্যান্ডের উত্তর দিকে। সেখানকার মানুষ তখনও চার্লস এর অনুগত।

 

১৬৪২ সাল থেকে ১৬৪৯ সাল অব্দি মহারাজার পক্ষের ও বিপক্ষের মানুষদের মধ্যে এক দীর্ঘ যুদ্ধ হয়। ইতিহাসে এই যুদ্ধ প্রথম ইংলিশ সিভিল ওয়ার নামে পরিচিত। মহারাজকে যারা সমর্থন করেছিল তাদেরকে বলা হয়, Royalists বা Cavaier। অপরক্ষে পার্লামেন্ট সমর্থনকারী পিউরিটানরা। এদের বিশেষ চুল কাটার ধরনের জন্য রয়ালিস্টরা এদেরকে Roundheads বলে আখ্যায়িত করত।

প্রথম দিকে কোন দলই খুব একটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। কিন্তু ১৬৪৪ এ পিউরিটানরা সম্ভাবনাময় নূতন জেনার‍্যাল অলিভার ক্রমঅয়েল কে পেল। ১৬৪৫ এ Cromwell এর New Model Army রয়্যালিস্টসদের হারাতে শুরু করল। ধীরে ধীরে বাজি পিউরিটানদের হাতে চলে এল। ১৬৪৭এ পিউরিটানরা রাজাকে কয়েদ করতে সমর্থ হয়।

 

১৬৪৯ সালে Cromwell ও পিউরিটানরা পার্লামেন্টের বিরুদ্ধে দ্রোহের অভিযোগে চার্লসকে বিচারের জন্য নিয়ে আসে। বিচারে চার্লস দোষী সাব্যস্ত হন এবং মৃত্যুদণ্ডাদেশ পান। দেহ থেকে মাথা আলাদা করে তাঁর মৃত্যু দণ্ড কার্যকর করা হয়। এইভাবে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। রাজার উপরে আইনের মর্যাদা স্থাপিত হয়। 

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ