ত্রিপুরার ইতিহাসে কুকি বিদ্রোহ
বিদ্রোহ মানব জাতীর ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। বিদ্রোহই মূলত সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। যখন শাসকরা হয়ে ওঠে ফ্যাসিবাদী, স্বার্থপর, মানবতা বিরোধী, তখন মানুষকে জেগে উঠতে হয়, বিদ্রোহ করতে হয়, আর মানুষ এক হয়ে গেলে পৃথিবীতে এমন কোনো শাসন নেই যা মানবতা রুখতে পারে। মাঝে মাঝে মনে হয়, শাসক মাত্রেই শোষক, বোধহয় শক্তির মধ্যে এমন কিছু আছে যা তাকে অপব্যবহার করতে বাধ্য করে। ত্রিপুরার ইতিহাসও বিদ্রোহহীন নয়, রিয়াং, ত্রিপুরি, জমাতিয়া, হালাম, চাকমা, মুন্ডা, সাঁওতাল, লেপচা সমেত মোট ১৯টি জনজাতির বাস এই রাজ্যে, রাজন্য আমলের শুরু থেকেই এরা নিজেদের আর্থসামাজিক দাবি জানাত সরকারকে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শাসকরা অগ্রাহ্য করতেন এদের দাবি, ফলস্বরূপ বেশ কয়েকবার প্রজাদের নামতে হয় বিদ্রোহে, তখন রাজারা লেগে পড়তেন বিদ্রোহ দমনে, কখনো প্রজা দমনে হিংস্রতার শেষ সীমায় পৌঁছে যেতেন রাজারা, ত্রিপুরার ইতিহাসে বিদ্রোহ দমনের এমন কয়েকটি নজির আছে, যা মনে করলে গা শিউরে ওঠে। সবগুলোই আমরা আলোচনা করবো, তবে আজকের বিষয় এরকম কোন বিদ্রোহ নয়, বরং এমন বিদ্রোহ যেখানে বিদ্রোহকারীরাই শোষক, হত্যাকারী, বিষয় হচ্ছে কুকি বিদ্রোহ।
ইতিহাসবিদদের মতে কুকিরা অসম্ভব সাহসী ও হিংস্র প্রবৃত্তির ছিল, তারা উপার্জনের জন্য লুঠ করতো। অনেক আগে থেকেই ত্রিপুরার মানুষদের মাঝে মধ্যে কুকিরা আক্রমণ করতো, যে গ্রামে ঢুকত সেখানে আর কিছু আস্ত অবশিষ্ট থাকতো না, মানুষ মেরে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে সব লুঠ করে নিয়ে যেত।
১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে মহারাজা কৃষ্ণ কিশোর মাণিক্যের শাসনকালে, লালচোকলা-র নেতৃত্বে কুকিরা কোচাবাড়ি ও প্রতাগড় আক্রমণ করে, অনেক প্রাণহানি হয়, কৃষ্ণ মাণিক্য অনেক চেষ্টা করেও লালচোকলা কে ধরতে পারেননি তখন। অবশ্য সেই বছরই ডিসেম্বর মাসে লালচোকলা গ্রেপ্তার হয়।
কুকিরা প্রায়ই এরকম আক্রমণ করতো, আর যেহেতু তারা রাজত্বের অধীনে ছিলনা তাই ত্রিপুরার রাজা বেশি কিছু করতেও পারতেন না। ১৮৪৯ সালেও এরা আক্রমণ করে, এইবারে লক্ষ্য ছিল কাছাড় ও চট্টগ্রাম, এখন এগুলো যথাক্রমে অসম ও বাংলাদেশের অন্তর্গত।
কুকিরা যে শুধু ভারতীয়দেরই হত্যা করত তা কিন্তু নয়, এদের ত্রাসে সন্ত্রস্ত ছিল ইংরেজরাও। ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে, রতন পুঁইয়ার নেতৃত্বে কুকিরা একাধিক আক্রমণ চালায়, জানুয়ারিতে ঢুকে পড়ে চট্টগ্রামে, তারপর ফেনী নদীপারের একের পর এক গ্রামে আক্রমণ চালাতে থাকে, বহু মানুষ মারা যায়, মৃতদের মধ্যে ছিল কিছুসংখ্যক ব্রিটিশও। পুলিশ, সেনাও কিছু করতে পারছিলনা, আক্রমণ শেষে এরা ঢুকে পড়ত পাহারে-জঙ্গলে।
ত্রিপুরায় তখন ঈশানচন্দ্র মাণিক্যের শাসন, ঈশানচন্দ্র ছিলেন দুর্বল শাসক, ঈশানচন্দ্র ও তাঁর মন্ত্রী গুরু বিপিন বিহারির হাতে প্রশাসন এতই দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে চাকলা রোশনাবাদের যে অঞ্চলগুলো কুকিদের হাতে আক্রান্ত হয়েছিল, সেখানের জন্যও কিছু করতে পারছিলেন না। ব্রিটিশ সরকার ও মহারাজা মোট ১৩,৭০০ টাকার ত্রাণ সংগ্রহ করেন আক্রান্ত স্থানগুলোর সাহায্য করার জন্য, গ্রামগুলোতে আর কিছুই অবশিষ্ট ছিলনা, এই ত্রাণের উপর ভিত্তি করেই গ্রামগুলোকে আবার নূতন করে স্থাপন করতে হয়েছে।
এই হিংস্র জনজাতির আক্রমণ রুখতে ব্রিটিশ সরকারও উঠে পড়ে লেগেছিল, পরের বছর অর্থাৎ ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে কুকি নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্রিটিশ সরকার ক্যাপ্টেন র্যাবন এর নেতৃত্বে একটা বিশাল সৈন্যদল পাঠায়। কিন্তু এইবার কুকিদের সঙ্গে রিয়াংরাও যোগ দেয়, আক্রমণ করে উদয়পুর, এবারও হয় বহু প্রাণহানি, সম্পত্তির ক্ষতি তো হয়ই, সবথেকে বেশি ক্ষতি হয়েছিল চাকমাদের। এইবারও ঈশানচন্দ্রের দুর্বল প্রশাসনকেই দায়ী করা হয়।
২২ জানুয়ারিতে হয় আরও এক বিধ্বংসী আক্রমণ, এইবার আক্রান্ত হয় উত্তর ত্রিপুরা ও সিলেট, এইবারেও নেতা ছিল রতন পুঁইয়া। রাজা এই আক্রমণও রুখতে পারেননি।
এইভাবেই কুকিরা জনজীবনে ব্যাঘাত দিতে থাকে। পরিস্থিতির পরিবর্তন হয় পরবর্তী রাজা, তথা বীরচন্দ্র মাণিক্যের সিংহাসনে বসার পর। না, কুকিদের জব্দ করে নয়। বরং রাজা শুরু করলেন কুকিদের উপহার দেওয়া, কারণ এছাড়া আর কোন উপায় ছিলনা। এই উপহার প্রদানের প্রথার নামকরণ করা হয়েছিল ভেট(vat)।
কুকিদের কোন দাবী ছিলনা, কাজেই এগুলোকে আন্দোলন বলা চলেনা। এতটুকু বলা যেতে পারে, কুকিদের বিদ্রোহ ছিল অযোগ্য রাজার বিরুদ্ধে, অথবা বিদ্রোহ নয়, নিছক লুঠ।
0 Comments